• apnbkm.09@gmail.com
  • +91 9233172388
  • Vidyasagar Pally, Rampurhat
  • Mon-Sat 11:00 A.M - 8:00 P.M

Thursday, May 3rd, 2018

Astro Palmist Numerology Center

মা কালি

মা কালি


“মা কালী” ব্রহ্মের মায়াশক্তি :-

মহাতীর্থ কালীঘাট - নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েই রোমাঞ্চ হল, শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ অনুভব করলাম। কালীঘাট, যোগক্ষেত্র কালীঘাট, শক্তিস্থল কালীঘাট, কাল জননীর বিলাসভূমি কালীঘাট। নিত্য জাগ্রতা মহাপ্রলয়ংকরী যথা লোলজিহ্বা বিস্তার করে বসে রয়েছেন। বসে রয়েছেন অগণিত সন্তানদের সর্বশেষ সত্যটি স্মরণ করাবার জন্য- "যাঁর গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়ে হয়েছিস মায়াবৃত জীব, সেই আমারই করাল গ্রাসে প্রবেশ করে হবি মায়ামুক্ত শিব।"
তন্ত্রচূড়ামণি বলছেন-

"নকুলেশঃ কালীঘাটে দক্ষপাদাঙ্গুলিষু চ।
সর্বসিদ্ধিকরী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।।"

সুদর্শনচক্রে ছিন্ন হয়ে সতীর যে অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছিল, তা হল "দক্ষপাদাঙ্গুলি" অর্থাৎ ডান চরণের চারটে আঙ্গুল। দেবীর ভৈরব নকুলেশ বা নকুলীশ ও দেবী স্বয়ং মহাকালী বা কালিকা। এছাড়াও ব্রহ্মযামলাংশ নিত্যপাঠ্য "আদ্যাস্তোত্রে" বলা হয়েছে " কালিকা বঙ্গদেশে চ," যার প্রমাণ এই বঙ্গভূমির শক্তিকেন্দ্র কালীঘাট। শাস্ত্রমতে এস্থানের কালীবিগ্রহ স্বয়ং ব্রহ্মা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বসিদ্ধি প্রদানে সদা উদ্যত।
কালীঘাটের মাতৃমূর্তি সম্পৃক্ত কিংবদন্তিটি কিন্তু বেশ রোমহর্ষকর-
দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বতে একদা ব্রহ্মানন্দ গিরি নামক এক একনিষ্ঠ শক্তিসাধক সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সম্মুখে অবস্থিত শিলাখণ্ডকেই সাক্ষাৎ বিশ্ববিমোহিনী তারা জ্ঞান করে কঠোর তপশ্চর্যায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু সাধনা ফলপ্রসূ না হওয়ায়ে ক্ষুব্ধ ব্রহ্মানন্দ আত্মাহুতি দিতে সচেষ্ট হলে মহামায়া তাঁকে দর্শন দিলেন। মহাদেবীর লোলজিহ্বা, করালপ্রতিমা সাধক সহ্য করতে পারলেন না, তাই মা কালী সুকোমল কুমারীমূর্তি ধরে সাধকের সামনে দাঁড়ালেন ও আজীবন সেই শিলাখণ্ডে আবদ্ধ থেকে পূজা গ্রহণ করবেন বলে কথা দিলেন। ব্রহ্মানন্দের মুখে হাসি ফুটল।
কিন্তু মা যে চিন্ময়ী, চঞ্চলা বালিকা। ভক্তের কাছে কথা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু লীলাচপলা শ্যামা কতক্ষণ আর সেই শিলাখণ্ডে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন। অবশেষে ইচ্ছাময়ী নিজেকে মুক্ত করার একটি উপায় নিজেই বের করলেন। শঙ্করাচার্য মঠের দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত আত্মারাম ব্রহ্মচারী তখন সুন্দরবনস্থ এই কালীঘাটের জঙ্গলে ছিলেন সাধনারত। আদ্যাশক্তি মহামায়া সেই সন্ন্যাসীর নিকট দশম বর্ষীয়া কন্যারূপে সহসা আবির্ভূতা হলেন। মহাদেবীর দিব্যবাণী গম্ভীর আদেশরূপে নেমে এলো-
"হে বৎস, আমি তোমার তপস্যায় প্রীত। শীঘ্র আমার আদেশ পালন করো। নীলগিরি পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরি নামক এক কঠোর তপস্বীর বাস। সে তাঁর সাধনা দ্বারা আমাকে তুষ্ট করে শিলাখণ্ডে বন্দী করে রেখেছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রহ্মানন্দের কাছে যাও ও তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমায় মুক্ত করে নিয়ে এসো। আর তুমি যে বেদীতে বসে সাধনা করছ, সেখানে এনে সেই শিলামূর্তি স্থাপন করো। সন্নিকটে যে হ্রদ দেখছ, তার নৈঋত কোণে আমার দক্ষিণ চরণের আঙ্গুল চতুষ্টয় পাষাণ অবস্থায় নিমজ্জিত রয়েছে। সেটা উদ্ধার করে বেদিমূলে নিহিত করো। ঈশানকোণে গভীর অরণ্যমধ্যে নকুলেশ ভৈরবও বিরাজ করছেন, তাঁকেও আবিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করো। আমি এইস্থানে করালবদনা কালীরূপে ভোগ ও মোক্ষ প্রদানার্থে প্রকটিতা হব।"

আত্মারামকে যাবতীয় আদেশ প্রদান করে মহাদেবী অন্তর্হিতা হলেন। দৈবী আদেশ মাথায় নিয়ে আত্মারাম নীলগিরি পর্বতে উপস্থিত হলেন ও ব্রহ্মানন্দের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। কিন্তু আত্মারামের মুখে আদ্যোপান্ত সব শোনার পরেও ব্রহ্মানন্দ কিছুতেই মাকে ছাড়তে রাজী হলেন না। দুজনের মধ্যে যখন এই কথোপকথন চলছে তখন হঠাৎ দৈববাণী হয়, এই মুহূর্তে নীলগিরি পর্বত সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাবে। তোমরা উভয়েই সেই আদিষ্ট শিলাখণ্ডে উঠে মাতৃনাম স্মরণ করতে থাক।
সত্য সত্যই কিছুক্ষণের মধ্যে ভূমিকম্প ও জলের ঢেউয়ে নীলগিরি টলতে লাগলো। হতবাক দুজনে শশব্যস্ত হয়ে শিলাখণ্ডে উঠতেই নীলগিরি জলের তোড়ে ভেসে গেল। আর মা কালীর অমোঘ মহিমায় তাঁরা দুজনে এসে পড়ল কালীঘাটের গঙ্গাকুলে। তদনন্তর মহামায়ার আদেশানুযায়ী ওই শিলাস্তম্ভে (দৈর্ঘ্য ১২ হাত ও প্রস্থ ২ হাত) কালিকামূর্তি এঁকে নির্দিষ্ট বেদীতে স্থাপন করে প্রত্যহ পূজা আরম্ভ হল। এরপর তাঁরা সেখানেই সাধনা করতে লাগলেন।
উপরোক্ত কাহিনীতে বর্ণিত আত্মারাম সপ্তদশ শতকে জীবিত ছিলেন। আর ব্রহ্মানন্দ ছিলেন প্রখ্যাত মঙ্গলচণ্ডীভক্ত শ্রীমন্তের সমসাময়ীক। বাংলাদেশের যেসব তন্ত্রসাধক তন্ত্র সম্বন্ধীয় বই লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে কৃষ্ণানন্দ, ব্রহ্মানন্দ ও পূর্ণানন্দের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়।
বিভিন্ন কাহিনী যদিও একাধিক মন্তব্য করেছে এই পীঠের পীঠাধিষ্ঠাত্রী কালিকা বিগ্রহ নিয়ে, কিন্তু শাস্ত্র স্পষ্ট বলছে এই পীঠের দেবী কালিকা প্রজাপতি ব্রহ্মা দ্বারা প্রতিষ্ঠিতা ও সুপূজিতা। দেবাসুরের সংগ্রামকালে দেবগণের হার নিশ্চিত হয়ে উঠলে পদ্মযোনি ব্রহ্মা সতীর চরণাঙ্গুলি ধন্য এই কালীক্ষেত্রে এসে তপস্যায় বসেন। এবং চিৎস্বরূপা জগদম্বার কৃপায় অচিরেই বাঞ্ছিত ফলপ্রাপ্ত হন। তৎপরে নিজ সাধন বেদীতে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে মায়ের ত্রিনয়নীরূপ প্রদান করে শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায়, বিশ্বকর্মা দ্বারা নির্মিত ও ব্রহ্মা দ্বারা অর্চিত কালীবিগ্রহই বর্তমানে কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহ আলো করে বিরাজ করছে।

প্রত্যহ কালীপুজা নিষ্ঠা সহকারে হয়ে থাকলেও কালীঘাট মন্দিরে বছরের একটি দিন বিশেষ আড়ম্বর সহ কালীপুজা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি হল বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসের কোন শনি বা মঙ্গলবার যেদিন অষ্টমী, নবমী বা চতুর্দশী থাকবে। সেদিন এই মন্দিরে দেবীকে রক্ষাকালীরূপে অর্চনা করা হয়। অসংখ্য ভক্ত এসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মঙ্গল ও রোগ নিবারণার্থে দেবীর শ্রীচরণপদ্মে প্রণত হন।

দুর্গাপূজার সময় আবার আরেক চমক। সেই চারটে দিন মা কালী ধারণ করেন মহিষমর্দিনীমূর্তি। শাস্ত্রীয় বিধিনির্দেশ অনুসরণ করে শুরু হয় কল্পারম্ভ। পুরোহিতগণের সমবেত কণ্ঠে ভেসে আসে মন্ত্র- "ওঁ কালিকা দুর্গারূপিণ্যৈ নমঃ।" মায়ের এই যে রূপ থেকে রূপান্তর, তা কার জন্য? তা ভক্ত-সন্তানদের জন্যই। যে সন্তান মাকে যে রূপে দেখতে পছন্দ করে, অনন্তরূপিণী লীলাবিশারদ জগদম্বা সেই রূপেই ভক্তের মানসপদ্মে পা রাখেন। ভ্রমর ছাড়া যেমন পুষ্পোদ্যানের শোভা অসম্পূর্ণ, ভক্ত ছাড়া তাঁর লীলাও যে তেমনই অসম্পূর্ণ।

আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক, উভয় দিক দিয়েই কালীঘাটের গুরুত্ব অপরিসীম। পুরাণ ও তন্ত্রে যেমন এই কালীপীঠের উচ্চ প্রশংসা করে সাধকগণ জোরহস্তে প্রণাম করেছেন, একইভাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে কালীঘাটের পরিদর্শনকারীদের মধ্যে এমন অনেকের নাম যারা আজ প্রাতঃস্মরণীয়। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কালীঘাটে এসেছিলেন, তিনি মায়ের বিগ্রহের ভিতর কন্যাকুমারী মূর্তি দর্শন করে ভাবাবিষ্ট হয়েছিলেন। ঠাকুর বলতেন, "মা ভবতারিণী সারাদিন কালীঘাটে জগতের আপিস কাছারি সামলে সন্ধ্যায় দক্ষিণেশ্বরে এসে বিশ্রাম করেন।"

নিজ গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বালক লোকনাথ ও বেণীমাধব এই কালীঘাটে এসেই সাধনা আরম্ভ করেন। এখানেই গুরু স্বীয় শিষ্য লোকনাথকে শিবকল্প মহাযোগী বলে চিনতে পারেন। বীরভূম থেকে বামাখ্যাপাও এসেছিলেন কালীঘাটে মাকে দর্শন করতে। মায়ের অপার্থিব রূপ দর্শনে বিহ্বল খ্যাপাসাধক বামা কোলে করে কালীঘাটের কালীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নিজের বড়মা তারামায়ের কাছে। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মাকে দর্শন করে বলেছিলেন, এই মা ও পুরীর জগন্নাথদেবের রূপের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ই এক। শ্রীমা সারদা যখন কালীঘাটে পূজা দিয়ে এয়োস্ত্রীদের সিঁথিতে সিঁদুর দিচ্ছিলেন, একটি অচেনা ঘোমটা দেওয়া মেয়েকে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। সিঁদুর পড়তে সম্মত হওয়ায় শ্রীমা মেয়েটির ঘোমটার ভেতরে কপালটি আন্দাজ করে সিঁদুর পড়িয়ে দেন। মেয়েটি ব্যাথা পেয়ে শিউরে ওঠে। ঘোমটা তুলতেই শ্রীমা পরম বিস্ময়ে দেখেন মেয়েটির কপালে রয়েছে একটি চোখ, যা সিঁদুরলিপ্ত হওয়াতে পিটপিট করছে। মা কালী চিরন্তনী, তিনি আজও লীলা করে চলেছেন একইভাবে। আমাদের চোখ নেই, তাই দেখতে পাই না। বা হয়তো, দেখেও দেখি না। কিন্তু কালীঘাটে মা কালী যে সদা জাগ্রতা, নিত্য সচেতন, তা বারংবার প্রমাণিত।

বামাক্ষ্যাপার কালীদর্শন-
নিষ্কাম শ্মশানপ্রেমিক বামাক্ষ্যাপা। মহারাজ যতীন্দ্রমোহনের আকুল আকুতিতে তারাপীঠ মহাশ্মশান ছেড়ে কোলকাতায় এসেছেন তিনি। বামাকে কালীঘাটে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন মহারাজ, তাঁর মুখেই শুনলেন কোলকাতার সম্রাজ্ঞী দেবী কালিকার মহিমা। সব শুনে মাতৃদর্শনের লোভে বালকভাবা ক্ষ্যাপা রাজি হলেন যেতে। কালীঘাটের সেবক হালদারদের সংবাদ পাঠানো হল "স্বয়ং বামদেব আসছেন দেবী দর্শনে।" আগুনের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। দলে দলে ভক্তেরা এসে ভিড় জমালেন মন্দির প্রাঙ্গনে।

ভোরের গাড়ি করে কালীঘাটে আনা হল বামাকে। কিন্তু একি? গর্ভমন্দির শূন্য কেন? বামা জানতে পারলেন তিনি আসবেন বলে আগামী ১ ঘণ্টার জন্য সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। ক্ষ্যাপা সন্তান জেদ ধরলেন, মায়ের মন্দিরে সবার সমান অধিকার। আর সকলের সঙ্গেই আমি মাতৃ দর্শন করব। তাই করা হল। মন্দিরের দ্বার হল সবার জন্য অবারিত।

বামাকে এনে দাঁড় করানো হল মাতৃমূর্তির সামনে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন এই "ছোট মার" দিকে। মা তারা তাঁর "বড় মা।" হৃদয়ের প্রেমসমুদ্রে দেখা দিল জোয়ার, চোখে গঙ্গাধারা। বিবশভাবে বলে উঠলেন, "এই যে আমার কালী মা। রূপের কি ছটা, মাথায় আবার মোহিনী জটা। যেমনি লকলকে জিভ, তেমনি টানা টানা চোখ, যেন জ্বলজ্বল করছে। তুই কাদের মেয়ে রে? চল না তোকে কোলে করে তারা মার কাছে নিয়ে যাই। আয় আমার কোলে......।"

আত্মবিস্মৃত উন্মত্ত বামা পাষাণময়ী বিগ্রহকে সত্য সত্যই কোলে তুলতে গেলে পাণ্ডারা বাধা দিলেন। স্পর্শ করতে দিলেন না নিত্যশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপাকে। বামার অন্তরে তীব্র আঘাত লাগলো, দিব্যভাবের অবসান হল। মায়ের স্নেহময়ী রূপ অন্তর্হিত হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল বিকটদশনা করাল প্রতিমা। ক্ষেপে উঠলেন বামদেব, "চাই না তোদের এই রাক্ষসী কালীকে, যেমন কেলে রূপ, তেমনি লকলকে, মস্ত জিভ, যেন গিলতে আসছে।" বালকের অভিমান হল মায়ের উপরে। বুঝলেন, মা-ই স্বয়ং বাধা দিয়েছেন পাণ্ডাদের মাধ্যমে। ধীর স্থির অচঞ্চল পদক্ষেপে বেরিয়ে এসেছিলেন মন্দির থেকে সেদিন। এভাবেই সাঙ্গ হয়েছিল বামার কালীঘাটের কালীদর্শন।

এরপরের যে ঘটনাটি আপনাদের সামনে তুলে ধরব, সেটি কিন্তু নিছক কাল্পনিক কথা বা কোন কবির মস্তিস্কপ্রসূত রচনা নয়। এই ঘটনার প্রামাণ্য চিঠিখানি আজও মজুত রয়েছে। হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, যিনি কামদেব ব্রহ্মচারী নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন, তাঁরই বংশধর সতীশ্চন্দ্র রায়চৌধুরী একটি জীর্ণ চিঠি উদ্ধার করেন। লেখকের জন্ম গোঘাটা গোপালপুর গ্রামে। পত্রটিতে রয়েছে কিছু আশ্চর্যজনক তথ্য,যা মানুষের নাস্তিক্যবুদ্ধিকে সহজেই নাড়া দেবে। সেই পত্রের কিয়দংশ সহজ ভাষায় তুলে ধরা হল-
"আমি আশৈশব মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত। আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে সংসার পরিত্যাগ করে নিজের স্ত্রী পদ্মাবতীকে সঙ্গে লয়ে অনন্তের সন্ধনে বেড়িয়ে পরেছি। ব্রহ্মচারী বেশধারণ করে তপস্যার জন্য পীঠমালাগ্রন্থে লিখিত 'বঙ্গদেশে চ কালিকা' অর্থাৎ আদিগঙ্গার তীরে যে স্থানে সতীর অঙ্গুলি পতিত
হয়েছে, যেখানে বিশ্বকর্মা দ্বারা নির্মিত পাষাণময়ী শক্তিপ্রতিমা ও তাঁর রক্ষক অনাদিলিঙ্গ ভৈরব
প্রকাশিত আছেন, সেখানে একটি পর্ণকুটিরে সস্ত্রীক একযোগে ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন ছিলাম।
প্রতিরাত্রে যথানিয়মে দেবীর অর্চনা করতাম। একরাতে পরমতত্ত্ব চিন্তা করছি, এমন সময় আমার
পত্নী পদ্মাবতী বলে উঠল- 'একি আশ্চর্য! এত শীঘ্র ভোর হয়ে এলো নাকি! পূর্বদিকে ওটা কি জ্বলছে?' আমিও তৎক্ষণাৎ বাইরে বেড়িয়ে এলাম, কিন্তু কিছুই আমার নয়নগোচর হল না। আমার স্ত্রী বারংবার
বলতে লাগলো- 'ওই দেখো, ওই দেখো কি তেজঃপুঞ্জ এক পদার্থ পূবদিক আলো করে রেখেছে।' কিন্তু আমার
দৃষ্টিতে কিছুই এলো না। হঠাৎ আমার মনে এলো, এ নিশ্চয়ই জগদম্বার ছলনা। তিনি ছাড়া এমন মায়াবিস্তার করা আর কার পক্ষেই বা সম্ভব! আমার স্ত্রী দেখতে সক্ষম,অথচ আমি বঞ্চিত। কেন? কি আমার অপরাধ? আমি সেই মুহূর্তেই ব্রতধারণ করে অনশনে বসলাম এবং অবিরাম বীজমন্ত্র জপে মগ্ন হলাম। একদিন, দুইদিন গত হয়ে তৃতীয়দিনে অকস্মাৎ দৈববাণী শুনতে পেলাম। গুরুগম্ভির
কণ্ঠে দশদিশি কাঁপিয়ে মহামায়া কালিকা বলতে লাগলেন-........ 'ভক্তরাজ, তুমি জন্মান্তরে আমার দর্শনলাভ করবে আর পদ্মাবতী দেহান্তে আমাতে লীন হবে। তোমার ঔরসে পদ্মাবতীর গর্ভে এক অতি সুলক্ষণযুক্ত পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। সেই পুত্র এ প্রদেশের ভূমাধিকারী ও অতুল ঐশ্বর্যশালী হবে। তার বংশ হতেই আমার সেবায়েতগণ প্রকাশিত হবে।' দেবীর এই দৈববাণী আমার অন্তরে প্রোথিত হয়ে রইল।

সত্যই কিছু বৎসর বাদে পদ্মাবতী গর্ভবতী হল, কিন্তু সন্তান প্রসব করেই সে ইহলোক ত্যাগ করল। আমি তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে একরাতে পুত্রের লালন পালনের চিন্তা করছি। এমন সময় এক কাণ্ড ঘটলো, কুটিরের ছাদ থেকে একটি টিকটিকির ডিম নীচে পড়ে ভাঙ্গল এবং সেই সদ্য শাবক বের হয়ে সম্মুখবর্তী একটি পিপীলিকাকে ধরে খেতে লাগলো। এই দেখেই আমার জ্ঞানোদয় হল।মহামায়ার মায়া বুঝতে পারলাম। এই জগতে একমাত্র তিনিই অভিভাবক। তিনি ছাড়া কেউই কারো জন্য নয়। কৃতাঞ্জলিপুটে বলতে লাগলাম- 'হে মাতঃ! সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারিণী, তোমার সৃষ্ট সন্তান তোমারই তত্ত্বাবধানে থাকল।' তৎপরে সকল মায়া ত্যাগ করে পুত্রের ভার আত্মীয়র উপর ন্যস্ত করে শ্রীশ্রীকাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।"

উপরোক্ত চিঠিতে যে জগন্মাতার দ্বারা নির্দেশিত যে সেবায়েতের উল্লেখ করেছেন লেখক, সেই হালদার পুরোহিতরা আজও মায়ের সেবাভার বহন করে চলেছেন। তবে ইতিহাস বলছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার পুরো শ্রেয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় অর্থাৎ, সাবর্ণ চৌধুরীর। এই সাবর্ণ চৌধুরী মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে জায়গীর পাওয়ার পর বেহালা গ্রামে বসবাস শুরু করেন এবং বর্তমান কালীঘাট মন্দির তৈরির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কারো কারো মতে ষোড়শ শতাব্দীর গোরার দিকে বর্তমান কালীঘাট মন্দির প্রতিষ্ঠার পূর্বেই গোবিন্দপুরে মা কালীর পূজার্চনা রীতিমত ধুমধামের সহিত শুরু হয়ে যায়। তাই অনুমান করা হয়, পরবর্তীতে মা কালীকে গবিন্দপুর থেকে বর্তমান কালীঘাটে স্থানান্তরিত করা হয়।

দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো :-
কালীঘাটের প্রতিষ্ঠা ঠিক কবে হয়েছিল তা বলা খুবই কঠিন। ইতিহাস, পুরাণকথা, কিংবদন্তী মিলেমিশে এমন হয়ে আছে যে তার থেকে এর প্রকৃত উদ্ভবের কাল উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত টলেমির ভারতের ভৌগোলিক বিবরণে এই অঞ্চলে কালীগ্রাম নামের এক জনপদের উল্লেখ আছে! আবার ভবিষ্যপুরাণের এক জায়গায় লেখা হয়েছে,
তাম্রলিপ্ত প্রদেশে চ বর্গভীমা বিরাজতে।
গোবিন্দপুরপ্রান্তে চ কালী সুরধুনীতটে।।
টলেমির কালীগ্রামই যে আজকের কালীঘাট— তার যেমন কোনও প্রমাণ নেই তেমনই টলেমির সমসাময়িক কালে লেখা ভবিষ্যপুরাণে গোবিন্দপুর গ্রামের উল্লেখ প্রায় অসম্ভব। আসলে কালীঘাটের প্রাচীনত্ব ও মহিমা জাহির করতে ওই সব তথ্য হাজির করা হয়েছে অনেক পরে। ইতিহাসগত ভাবে কালীঘাটের কথা জানা যায় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। কথিত আছে, আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে এক দলছুট সন্ন্যাসী ঘুরতে ঘুরতে কালীঘাট অঞ্চলে নির্জন বনের মধ্যে পর্ণকুটির তৈরি করে বসবাসকালে একটি বড় প্রস্থরখণ্ডকে কালীরূপে পুজো করতেন। তিনি এবং ব্রহ্মানন্দ গিরি নামে আর এক সন্ন্যাসী সংলগ্ন কুণ্ড থেকে একটি ছোট পাথরখণ্ড খুঁজে পান। তাঁরা সেই খণ্ডটি সতীর দক্ষিণ পদের কনিষ্ঠ অঙ্গুলী বলে দাবি করেন। পরে সেটিকে বড় পাথরটির নীচে স্থাপন করেন। সতীপীঠ হিসেবে কালীঘাটের পরিচিতির সূচনা তখন থেকেই।

আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দের পর থেকে দীর্ঘকাল মূলত সন্ন্যাসীদের হাতেই ছিল কালীঘাটের পুজোর ভার। তাঁরা প্রধানত শৈব হলেও তন্ত্র মতে শক্তির উপাসনাও করতেন। ইতিমধ্যে শক্তিপীঠ হিসেবে কালীঘাট যথেষ্ট পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রথমে যশোহরের রাজা বসন্ত রায় ও পরে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আনুকূল্যে তৈরি হয়েছে মন্দিরও। সেই সময়ে অন্যান্য শৈব ও শক্তি পীঠগুলির ন্যায় কালীঘাটেও মন্দিরের সেবাপুজো ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার থাকত সন্ন্যাসীদের হাতে। ভুবনেশ্বর গিরি নামে এমনই এক তান্ত্রিক সেবাইত ও তাঁর ভৈরবী যোগমায়ার, উমা নামে এক কন্যা জন্ম নেয়। ওই উমাকে কেন্দ্র করে পাল্টে যায় কালীঘাটের সেবাপুজোর ইতিহাস।

যশোহরের জনৈক পৃথ্বীধর চক্রবর্তীর ছেলে ভবানীদাস তাঁর হারিয়ে যাওয়া বাবার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে কালীঘাটে উপস্থিত হন। ভবানীদাস আদতে ছিলেন কৃষ্ণের উপাসক কিন্তু নানা কারণে তিনি কালীঘাটে থেকে যান এবং নিজের ইষ্ট দেবতা বিষ্ণুর পাশাপাশি কালীরও উপাসক হয়ে ওঠেন। কালীর পুজোয় ভবানীদাসের নিষ্ঠা দেখে ভুবনেশ্বর গিরি তাঁর সঙ্গে মেয়ে উমার বিয়ে দিলেন এবং তাঁকেই করে গেলেন কালীঘাট মন্দিরের ভবিষ্যত্ উত্তরাধিকারী। শেষ হল সন্ন্যাসীদের যুগ, কালীঘাটের দেবী দক্ষিণাকালীর সেবাপুজোর ভার অর্পিত হল গৃহস্থ-সেবায়েত ভবানীদাস চক্রবর্তীর হাতে। সেই শুরু। কালীঘাটের আজকের সেবাইত হালদারেরা ওই ভবানীদাসেরই উত্তরপুরুষ।

শাক্ত পরিবারের সন্তান হলেও ভবানীদাস নিজে ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। যশোহরের খনিয়ান গ্রামে ছিল তাঁর কুলদেবতা বাসুদেব। ভবানীদাস কালীঘাটে থাকাকালীন, গ্রামের বাড়িতে তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী-পুত্রেরাই পুজো করতেন কুলদেবতার। কালীঘাট মন্দিরের সব দায়িত্ব পাওয়ার পরে তিনি যশোহর থেকে পরিবারকে নিয়ে আসেন কালীঘাটে। পরে কুলদেবতার বিগ্রহও নিয়ে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন দক্ষিণাকালীর মূর্তির ঘরেই। একই সঙ্গে চলল কালী ও কৃষ্ণের পুজো। বিষ্ণুভক্ত কালীসেবক ভবানীদাসই প্রথম কালীর নাসিকাগ্রে আঁকেন বৈষ্ণবীয় তিলক। সেই প্রথা আজও বজায় আছে। তিলক আঁকার পাশাপাশি কালীপুজোর দিন কালীঘাটে লক্ষ্মীপুজোর প্রবর্তনও করেন তিনি। দীপান্বিতার সন্ধ্যায় এই পুজো হয়, তাই এর নাম দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।
কালীঘাট মন্দিরে কালীপুজোর সন্ধ্যার এই লক্ষ্মীপুজো একান্ত ভাবেই সেবাইতদের পুজো, এর সঙ্গে কালীঘাট মন্দির কমিটির বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই। অমাবস্যা তিথি থাকলে কালীপুজোর দিন সূর্যাস্তের ২৪ মিনিটের মধ্যে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। তার আগে অবশ্য সেরে নেওয়া হয় অলক্ষ্মী বিতাড়ন পর্ব। তিন বা চার ইঞ্চি মাপের অলক্ষ্মী পুতুল তৈরি করা হয় গোবর বা জলে চটকানো পিটুলি (চালবাটা) দিয়ে। সেটিকে রাখা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে। এ বার অলক্ষ্মী পুতুলের সামনে পাটকাঠিতে আগুন লাগিয়ে সেবাইতরা তিন বার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। আর জোরে জোরে কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায় করে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। এটি যেহেতু সেবাইতদের পুজো তাই নিরামিষ ভোগ আসে সেবাইতদের বাড়ি থেকেই। সেগুলি রাখা হয় কালীমূর্তির সামনেই। আবার কালীর যে হেতু আমিষ ভোগ, সেখানে মাছ-মাংসও থাকে, সেগুলিও রাখা হয় তার পাশেই, তবে লক্ষ রাখা হয় যেন আমিষ ও নিরামিষ ভোগ ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়। ভোগ ছাড়াও সেবাইতরা দেন তাঁতের শাড়ি। সেগুলি কালীর অঙ্গেই পরানো হয়। ভোগ-বসন সাজানোর পরে পুরোহিত পুজো শুরু করেন। প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হয় কালীপুজোর সন্ধ্যার ওই দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।

শেষ কথাঃ
জীবনের সাথে এই শক্তির খেলা আর্য্য ঋষিগণ তাঁদের জ্ঞানদীপ্ত উপলব্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সৃষ্টিতে প্রকৃতিরূপা মাতৃশক্তির রূপ কল্পনা কালী মূর্তিতে। শক্তির আধারভূতা দেবী শ্রী শ্রী কালীমাতা সকলের পরিত্রাণ করুক, সকলের জীবনে কালীমায়ের মূর্তির তাৎপর্য প্রাণবন্ত হোক, কর্মে সাত্ত্বিকতা আসুক- এই প্রার্থনা রাখি।
আর্য্যঋষিদের দেবদেবী কল্পনায় অধিকাংশ আধ্যাত্মিক বৈদিক, লৌকিক, আঞ্চলিক দেবদেবীর বাহনরূপে পশুপাখির অবস্থান নির্ণয় করেছের। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো দেবী কালিকার ক্ষেত্রে। এখানে দেবীর বাহনরূপে শিবা, শিব, শব কাকে বাহন নির্দিষ্ট করেছেন, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি দেবীকে শিবারূঢ়া বলতে শিবের উপর অবস্থিত বোঝায়। অপর পক্ষে শিবা শব্দে শৃগাল বোঝায়। এ কারণে অনেক স্থলে মায়ের মূর্তির সাথে শৃগালকেও দেখানো হয়। কিন্তু মায়ের সাথে শৃগালের যুক্ততা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। শবারূঢ়া বা শিবারূঢ়া যা-ই বলি শব হয় শক্তিহীনতায় আর শিব হয় মঙ্গলকারী শক্তিমানতায়। উভয়ই শক্তির অবস্থান নির্ণয় করে। যে শক্তি সবংত্র বিরাজিত নানরূপে কার্যকারিতায় তাঁর বাহন নির্ধারণ না করাই যুক্তিগ্রাহ্য বলে ঋষিগণ এ বিষয়ে দৃষ্টি দেননি।
কালীবীজ জপলে ও তদনুযায়ী গুরুপাদিষ্ট মতে ক্রিয়া করলে তত্ত্বময়ী কালী সাধকের কাছে উপস্থিত হয়ে যান। কৃষ্ণানন্দ, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষেপা প্রমুখ সাধকের কালী দর্শনে মুগ্ধ তন্ময়। ‘‘প্রত্যয় হয় প্রত্যক্ষ হলে।’’ সমস্ত যোগতত্ত্ব কথা গুরুবক্তগম্য। সকল তত্ত্ব নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যদি গুরুপাদিষ্ট মতে সাধন ভজন করা যায়। মানুষকে সাধনমুখী, সত্যমুখী করার জন্যই পূজার ও দেব-দেবীর মূর্তির অবতারণা। কালীপূজা আমাদেরকে কালীতত্ত্বভিমুখী করুক-এই প্রার্থনা মায়ের শ্রী চরণে। কালী ভাবনায় জীবনের সকল কালো দূর হয়ে যাক আসুক মহাকালের গতি।
শক্তির আসল পূর্ণাঙ্গরূপ আমাদের দেখিয়েছেন আর্য্য ঋষিগণ কালীমাতার মধ্যে। ঋষি অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে মায়ের যে সকল মূর্তি আছে তাঁর মধ্যে মূলে রয়েছে কালীমাতা।
জীবনের সাথে এই শক্তির খেলা আর্য্য ঋষিগণ তাঁদের জ্ঞানদীপ্ত উপলব্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সৃষ্টিতে প্রকৃতিরূপা মাতৃশক্তির রূপ কল্পনা কালী মূর্তিতে। শক্তির আধারভূতা দেবী শ্রী শ্রী কালীমাতা সকলের পরিত্রাণ করুক, সকলের জীবনে কালীমায়ের মূর্তির তাৎপর্য প্রাণবন্ত হোক, কর্মে সাত্ত্বিকতা আসুক- এই প্রার্থনা রাখি।

আর্য্যঋষিদের দেবদেবী কল্পনায় অধিকাংশ আধ্যাত্মিক বৈদিক, লৌকিক, আঞ্চলিক দেবদেবীর বাহনরূপে পশুপাখির অবস্থান নির্ণয় করেছের। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো দেবী কালিকার ক্ষেত্রে। এখানে দেবীর বাহনরূপে শিবা, শিব, শব কাকে বাহন নির্দিষ্ট করেছেন, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি দেবীকে শিবারূঢ়া বলতে শিবের উপর অবস্থিত বোঝায়। অপর পক্ষে শিবা শব্দে শৃগাল বোঝায়। এ কারণে অনেক স্থলে মায়ের মূর্তির সাথে শৃগালকেও দেখানো হয়। কিন্তু মায়ের সাথে শৃগালের যুক্ততা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। শবারূঢ়া বা শিবারূঢ়া যা-ই বলি শব হয় শক্তিহীনতায় আর শিব হয় মঙ্গলকারী শক্তিমানতায়। উভয়ই শক্তির অবস্থান নির্ণয় করে। যে শক্তি সবংত্র বিরাজিত নানরূপে কার্যকারিতায় তাঁর বাহন নির্ধারণ না করাই যুক্তিগ্রাহ্য বলে ঋষিগণ এ বিষয়ে দৃষ্টি দেননি।

কালীবীজ জপলে ও তদনুযায়ী গুরুপাদিষ্ট মতে ক্রিয়া করলে তত্ত্বময়ী কালী সাধকের কাছে উপস্থিত হয়ে যান। কৃষ্ণানন্দ, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষেপা প্রমুখ সাধকের কালী দর্শনে মুগ্ধ তন্ময়। ‘‘প্রত্যয় হয় প্রত্যক্ষ হলে।’’

সমস্ত যোগতত্ত্ব কথা গুরুবক্তগম্য। সকল তত্ত্ব নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যদি গুরুপাদিষ্ট মতে সাধন ভজন করা যায়। মানুষকে সাধনমুখী, সত্যমুখী করার জন্যই পূজার ও দেব-দেবীর মূর্তির অবতারণা।।

শ্রী অরবিন্দেরও কালী দর্শন হয়েছিল যা অনেকেরই অজানা। মা সৃষ্টি ও রক্ষা দু’টোই করেন। ধ্বংস অনিবার্যভাবে সৃষ্টির ক্রম অনুযায়ী আসে। মানুষ বিপদে পড়লে মাকে ডাকে। ছোট শিশু মায়ের স্পর্শেই শক্তি পায়। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষ ঘুমের মাধ্যমে মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে পুনঃশক্তি সঞ্চার করে কর্মে প্রবৃত্ত হয়। মায়ের কোলেই সন্তানের যে কোন সময় একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের সস্নেহেই মানুষের বৃদ্ধি ঘটে। মা সর্বব্যাপী আছেন। তাই মাকে সর্বদা স্মরণে রেখে প্রণাম জানাই-

দয়াং কুরু মহেশানি পামরেষু জনেষুহ হি।
সর্বাপরাধযুক্তেষু নৈতৎ শ্লাঘ্যং তবাম্বিকে।।
কোপং সংহর দেবেশি সর্বান্তর্যামিরূপিণি।
ত্বয়া যথা প্রের্য়তে যঃ করোতি স তথা জনঃ।।
নান্যা গতির্জনস্যাস্য কিং পশ্যসি পুনঃ পুনঃ।
যথেচ্ছসি তথা কর্তুংসমর্থাসি মহেশ্বরি।।
সমুদ্ধর মহেশানি সঙ্কটাৎ পরমোত্থিতাং।
জীবনেন বিনাস্মাকং কথং স্যাৎ স্থিতিরম্বিকে।।
প্রসীদ ত্বং মহেশানি প্রসীদ জগদম্বিকে।
অনন্তকোটিব্রহ্মাণ্ডনায়িকে তে নমো নমঃ।।

[ হে মহেশানি ! আপনি আমােদর প্রতি দয়া করুন। হে অম্বিকে ! সমস্ত অপরাধে অপরাধী পামরজন সকলের উপর এইরূপ কোপ করা অাপনার শ্লাঘনীয় নয়। অতএব দেবেশি ! আপনি ক্ষমা করুন। যদি অামাদের পাতক বশত অাপনার কোপ হয়ে থাকে তবে সে-বিষয়েও অামাদের কোনো অপরাধ নেই ; কারণ অাপনিই অন্তর্যামিনীরূপে সকলের হৃদয়ে বাস করেন। সুতরাং অাপনি যাকে যে কাজে নিযুক্ত করেন, সে তাই-ই করে থাকে। হে মহেশ্বরী ! যখন অাপনি ভিন্ন জনগণের অার কোনো গতি নেই , তখন কি কারণে পুনঃ পুনঃ তাদের এরূপ দুর্দশা দর্শন করাচ্ছেন ? মাতঃ! অাপনি তো যেরকম ইচ্ছা করেন, সেইরকম কার্য করতেই সমর্থ ; অতএব হে মহেশানি ! উপস্থিত এই নিদারুণ সঙ্কট থেকে জীবগণকে পরিত্রাণ করুণ। হে অম্বিকে ! জল ব্যতীত কিভাবে অামরা জীবনধারণ করি বলুন ? হে মহেশানি ! হে জগদম্বিকে ! অাপনি প্রসন্না হন। হে অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরী ! অাপনাকে অামরা বারংবার প্রণাম করি। ]
জোতিষ শাস্ত্রে, দক্ষীনাকালী শনির ইষ্টদেবী।
বীজমন্ত্র:ঔঁ ঐং হ্রীং ক্লীং হূং দক্ষীনা কালিকাঐ নমঃ।
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
- শ্রী শ্রী চন্ডীঃ ৩৭
KUSH MUKHERJEE
RAMPURHAT CHAKLAMATH BIRBHUM
CONTACT NO 7001608953
Website:www.apnc.co.in



Blog Url:
https://apnc.co.in/blog.php?blog=20180503090124